• কাজী মশহুরুল হুদা।

বাঙালীর ইতিহাস, হাজার বছরের ইতিহাস। বাঙলা একটি জাতির স্বত্তা। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই বাঙালী জাতির স্বাধীন স্বত্তা হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বাধীন বাংলাদেশের যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’।

এই বাঙালী জাতীয়তাবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রাচীনকাল থেকে দক্ষিণ এশিয়াতে বসবাসরত বাঙালি জাতি তথা বাংলা ভাষাগত অঞ্চলের অধিবাসীদের বোঝানো হয়েছে। যা ব্রিটিশ চক্রান্তে অবিভক্ত বাংলাকে বিভক্ত করে। প্রাচীন বঙ্গদেশ, অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের একতাবদ্ধ পরিচয়কে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলা হয়। যাদের ইতিহাস অন্তত: চার হাজার বছর পুরোন এবং এদের মাতৃভাষা বাংলা।

অতএব, বাঙালীর জাতীয়তাবাদ- বাংলার ইতিহাস এবং সেই সব মানুষের ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এই সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রাই বাঙালিপনা, বাঙলার অথবা বাঙালির কর্মকাণ্ড।

১৯৭১ সালে বাংলার কিছু অংশ মিলে নতুন একটি স্বাধীন বাংলার দেশ গঠিত হয়েছে। যার নাম বাংলাদেশ (একটি জাতি থেকে একটি রাজ্য বা দেশে পরিনত হয়েছে)। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হওয়ার ফলে বাঙলার উপর ধর্মীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়, যা ভারতের অধিরাজ্যের বাংলায় হিন্দুধর্মীয় প্রভাব পড়ে এবং পাকিস্তান অধিরাজ্যের পূর্বপাকিস্তান রূপে আর্বিভূত বাংলায় (বর্তমানের বাংলাদেশ রাষ্ট্র) ইসলাম ধর্মের প্রভাব বিরাজমান। সে ক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতিতে ধর্মীয় প্রভাব ভৌগলিকতায় সাংস্কৃতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

মূল কথা হল- বাঙালীর জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বুদ্ধিবৃত্তি তথা নিজস্ব জাতিসত্ত্বাকে বোঝায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমাদের আত্মপরিচয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলার গুরুত্ব উপলব্ধি করায় এবং মানসিক ধারণা থেকে অনুভূতি মূলক প্রেরণার তাগিদ সৃষ্টি করে।

সময়ের পালা বদলে নাট্য, নৃত্য, সঙ্গীত এর মত এখন প্রশ্ন উঠেছে- মূকাভিনয়ের ক্ষেত্রেও। বাঙালি জাতি হিসেবে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মূকাভিনয়ে আমাদের নিজস্বতা রয়েছে কিনা? করা যায় কিনা অথবা কেমন হওয়া উচিৎ আমাদের মূকাভিনয়?

আমি বলি অবশ্যই নিজস্বতা রয়েছে। কারণ বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি। হাজার বছরের মানুষের জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি। যেমনভাবে গড়ে উঠেছে ফরাসী, বৃটিশ, চাইনীজ, জাপানিস সংস্কৃতি।

প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে এতদিন পর এই প্রসঙ্গ কেন? ইতিপূর্বে এবিষয়ে ভাবা বা প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি কেন?

স্বাধীনতাউত্তোর বাংলাদেশে মূকাভিনয় শিল্প মাধ্যম ছিল সম্পূর্ণ নতুন। মূলত এই চর্চ্চার বাস্তব যাত্রা শুরু হয় সত্তর দশকের দিকে। বঙ্গবন্ধুর বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনায় নিজস্ব সংস্কৃতিতে মূকাভিনয়কে ‘বাঙালী মূকাভিনয়ের স্বরূপ বা স্বতন্ত্র সক্রিয়তা’ দিয়ে নির্মাণ করার প্রচেষ্টা শুরু করেছিলাম। যা হবে শুধুই আমাদের অর্থাৎ বাঙালি জাতির মূকাভিনয়ের ব্রান্ডিং। আন্তর্জাতিকভাবে তা হবে ব্রিজিং এবং সর্বপরি হয়ে উঠবে ব্রেডিং। ১৯৭৪ এর পর আমার মূকাভিনয়ের যাত্রা যার শুরু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্র থেকে। তখন বাংলাদেশে চলছে বাঙলা নাটকের নিজেস্ব করনের গবেষণা। আমি তখন নাট্যচক্রের নাট্য কর্মী। আমার মূকাভিনয় শিল্প কর্মে তার প্রভাব ছিল। ১৯৮১ সনে শিল্পকলা একক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এরপর ১৯৮৩ সনে প্রথম উত্তর আমেরিকা মাইম ফেস্টিবলে অংশগ্রহণ করি। সেখানে আমার স্কেচ ছিল ‘বাঙলার রমনী’ (বেঙ্গল লেডি)। সেটি তৈরি করেছিলাম নিজস্ব ডিজাইনের ড্রেস দিয়ে। এরপর সেই প্রদর্শনী হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে ওয়াল্ড এক্সপোতে। ওই প্রদর্শনীতে ইন্টারন্যাশনাল মাইম এ্যাম্বাসেডর অব বাংলাদেশ উপধিতে আমাকে সম্মানিত করা হয়। সময়টা ছিল ১৯৮৬ সালের দিকে।
এখন মূকাভিনয়কে কেন জাতীয়করনের চিন্তাভাবনা চলছে?
আমাদের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন জাতির এখনই সময়। কারন দেশ উন্নয়নের ধারায় এগোচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি যদি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নয়ন না হয় বা সমৃদ্ধ না হয় সে জাতির আইডেন্টিটি বা নিজেস্ব ব্যান্ডিং তৈরি করা যায় না। এখন আমাদের সময় এসেছে। নতুন করে ভাববার। থিয়েটারে যেমন বাঙালীর থিয়েটার গড়ে তোলা হচ্ছে তখন পাশাপাশি মূকাভিনয়ের বাঙলা মূকাভিনয়ের স্বরূপ গড়ে তোলার গুরুত্ব দেখা দিয়েছে।

দেশে এখন মূকাভিনয়ের চর্চ্চা খুবই আশাব্যঞ্জকভাবে শুরু হয়েছে। ছিন্ন ছিন্নভাবে থাকা শিল্পীরা একত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন প্লাটফর্মে। একতাবদ্ধ হয়ে কিছু করার চেষ্টা করছে তারা। এ কাজে তাদের সাধুবাদ জানাই। তাদের বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখে এবং আলোচনা শুনে মনে হলো আমাদের মূকাভিনয়ের একটা নিজস্বতা থাকা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই কিছু করা জরুরী। নতুনদের জন্য যা হবে দিকনিদর্শনা ও পথের সন্ধান।
‘ বাঙলা মূকাভিনয় অথবা বাঙালি মূকাভিনয় বা বেঙ্গল মাইম’ সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই আমার এই প্রচেষ্ট।

আমরা সবাই জানি- ‘মূকাভিনয় একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম’। ইউরোপিয়ান মতাদর্শে যা নির্মিত হয়েছে নৃত্যশিল্প ও নাট্যশিল্পের বর্ডার লাইনের অবয়বে। মনেরভাব দৈহিক ভাষায় ছন্দময়তা ও অভিনয়ের আলোকে ফুঁটিয়ে তোলার মাধ্যম এটি। সেখানে না থাকবে নৃত্যের, না থাকবে নাট্যের ধারা। থাকবে শুধু মূকাভিনয়ের নিজস্ব ধারা।

মূকাভিনয়ের রয়েছে নিজস্ব ফর্ম, স্টাইল এবং টেকনিক। যা চিরন্তন বা ইউনিভার্সল। কিন্তু স্থান, কাল পাত্র ভেদে জীবনযাত্রা ভিন্নতর দেখা যায়। আমাদের চাল-বলন, বসন, চলন ইত্যাদির জীবন প্রনালী বা জীবনযাত্রা অন্য জাতি থেকে আলাদা। পোশাকে পরিচ্ছদে, রীতিনীতিতে, চলন বলনে, খাওয়া দাওয়ায় ইউরোপিয়ান অথবা চাইনিজ বা জাপানিজ থেকে ভিন্নতর। এই ভিন্নতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে স্টাইলের পরিবর্তন রয়েছে। নতুন নতুন টেকনিকের সৃষ্টি হয়েছে। তবে ফর্মের ক্ষেত্রে সবই সমান। অনুভূতির প্রকাশ সর্বকালে সকলের মাঝে সমান। দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ, উচ্ছাস ইত্যাদির বহি:প্রকাশ সকল জাতির কাছেই এক রকম। মানুষের অনুভূতি প্রকাশে ভিন্ন জাতির কাছে কোন পার্থক্য নেই।

আমরা বলে থাকি ফরাসি মাইম, বৃটিশ মাইম, আমেরিকান মাইম ইত্যাদি। এমনটা বলার কারণ, এগুলো সব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা জীবনযাত্রার প্ররিস্ফুটন। যেহেতু বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, তাই আমাদেরও একটা ভিন্ন দর্শন থাকা জরুরী। গ্রাম বাংলার জীবনযাত্রা আবহমান কালের। বাঙালির মূকাভিনয়ে এর চিত্র তুলে ধরতে পারলেই অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

সময় এসেছে বাঙালি মূকাভিনয়কে সুস্পস্টভাবে দাঁড় করানোর। এটা করতেই হবে। আমাদের নির্ণয় করতে হবে ‘বাংলার মূকাভিনয় দর্শন’।

আমি দেখেছি আমাদের তরুণ শিল্পীদের অনেকেই ভিনদেশিদের ধারায় আক্রান্ত। এর কারণ যদিও আমরা। আমরা এতো বছরেও নিজেদের ধারা তৈরি করতে পরিনি। তাই এই বাংলায় পাশ্চাত্যের ছোঁয়া লাগার পূর্বে বাঙালি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধারায় ফিরে আসতে হবে। যে সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার গল্প আছে, জীবনযাত্রার ছবি আছে তার আলোকেই আমাদের মূকাভিনয় ধরণ নির্ণয় করতে হবে। ওটাই হবে বাঙলা মূকাভিনয়ের বৈশিষ্ট্য, ঐহিত্য এবং স্বরূপ।

এ ক্ষেত্রে শহরকে বেছে নিলে চলবে না। আমাদের গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রাই আমাদের সংস্কৃতি। ভাষা, রাজনৈতিক, সামাজিকতা, কৃষ্টিতে বাঙালিআনা থাকতে হবে। চলন-বলন, কথন সব ক্ষেত্রেই এইসব উপকরণ অবলম্বন করে মূকাভিনয় ফর্মে, স্টাইলে এবং টেকনিকে আমাদের জীবন প্রণালী ফুঁটিয়ে তুলতে হবে। যা হবে বাঙলার মূকাভিনয় , বাঙালির মূকাভিনয়। যাকে আমরা বলবো- ‘বাঙলা মূকাভিনয় বা বেঙ্গলী মাইম’।

আমি বাঙলা মূকাভিনয়ের উপর সিরিজ ভিডিও নির্মাণের পরিকল্পনা করছি। যাতে হাতে-কলমে চর্চ্চার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে আশা রাখি।

মূকাভিনয়ের প্রধান উপাদান হল দেহ এবং মনকে কেন্দ্র করে। ফর্ম, স্টাইল এবং টেকনিকের ব্যবহার হয় দেহের মাধ্যমে এবং মনের দ্বারা। দেহের ভাব ভঙ্গিমার মাধ্যমে প্রকাশ পায় গল্প, স্কেচ এবং বিষয় বস্তু। চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটে উপস্থাপনার মাধ্যমে। জাতীয়তাবাদের তত্ত্বের উপায়ও আসে চিন্তাধারার মাধ্যমে। আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা অভিজ্ঞতার আলোকে ফুঁটিয়ে তুলতে পারলেই প্রকাশ পাবে বাঙালীর বাঙলা মাইম বা মূকাভিনয়। যেমন- আমার দেশের মাছ ধরার কৌশল, মাঝি মাল্লাদের দাঁড়টানার চিত্র, গরুর গাড়ি, দই বিক্রেতা ,কৃষক, কৃষি ও প্রকৃতি, গ্রামীণ নারীর চালচিত্রই আমাদের সম্পদ। যা অন্য জাতির থেকে আলাদা ও ভিন্নতর। সেইগুলোই হবে আমাদের মূকাভিনয়ের অবলম্বন।

এখন আসা যাক ব্যবহারিক প্রক্রিয়া। পারফরম্যান্স এর ক্ষেত্রে কি ভাবে বাঙালীর মূকাভিনয় হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। পাশ্চাত্যের ফর্ম থেকে বাঙলা মূকাভিনয়ের বৈশিষ্ট্য বা পার্থক্য আনতে গেলে আমাদের ঐতিহ্যের ভান্ডার থেকে সংস্কৃতির সংযোজন ঘটাতে হবে। যেমন যাত্রা আমাদের নিজেস্ব শিল্প। সেই শিল্পের সংমিশ্রমে নির্মাণ করতে পারি স্কেচ। যা হতে পারে বাঙলা মূকাভিনয়ের ফর্মের অংশ এবং বিবেক বা সূত্রধর চরিত্রের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ গল্প বা ঘটনার বা পর্বের বিবরন দিয়ে কোন একটি মুদ্রা’র ফ্রোজেন পোজ থেকে মূকাভিনয়ের শুরু হতে পারে সেই সাথে ঢাক ঢোল পিটিয়ে অথবা ডুগডুগি বাজিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে কথোপকথনের দ্বারা মূকাভিনয়ের পারফরম্যান্স শুরু করা যেতে পারে যা নির্ভর করবে একক বা দলগত মূকাভিনয়ের উপর। ২০১১ সালের শিল্পকলা একাডেমির মূকাভিনয় ওয়ার্কশপে এধরনের এক্সপেরিমেন্ট আমি করেছিলাম। সাথে ছিল দলগত ফেস্টুন।

মেকাপ নিয়ে কথা উঠছে। বাঙলা মূকাভিনয়ের মেকাপ কি রকম হবে? পাশ্চাত্যের আদলে হবে নাকি নিজেস্ব কোন ধরন থাকবে? মূকাভিনয়কে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিতে হলে মূকাভিনেতাকে মেকাপ ছাড়া বাস্তবতার সাথে সংগতি রেখে মূকাভিনয় করা উচিত। মেকাপের প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আমিও মনে করি। এক্ষেত্রে বাঙলা মূকাভিনয়ে মেকাপ ছাড়া থিয়েট্রিক্যাল মেকাপ ব্যবহার করা যেতে পারে এবং চরিত্র নির্ভর মেকাপ।

এখন আশা যাক পোশাকে। বাঙলার মূকাভিনয়ে বাঙালীর জাতীয়তাবাদের ছাপ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। পাশ্চাত্যের শিল্পীরা তাদের সমকালীন পোশাক পরিচ্ছেদ ব্যবহার করেন। সেক্ষেত্রে আমরা আমাদের কৃষ্টি পোশাকে তুলে ধরব। এক্ষেত্রেও দুভাবে প্রকাশ পেতে পারে। এক নিজেস্ব স্টাইলে দেশজ উপকরণে কমন ড্রেস যা সকল মূকাভিনয় স্কেচ এ ব্যবহারিত হতে পারে অথবা চরিত্রের আলোকে দেশীয় উপকরণে নির্মিত পোশাক ব্যবহার করা।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এর উপর নির্ভরশীল হতে পারে পোশাকের ধরন। যেমন, চার্লির ড্রেস ছিল ভেগাবন্ড, মার্সেল মারসুর বিপ চরিত্রের। তিনি টোকাই চরিত্রের হতে পারে দেশীয় উপকরণের ব্যবহার ।

পাশ্চাত্যের মূকাভিনয়ের সংজ্ঞা হল, বর্ডার লাইন বিটুইন থিয়েটার এন্ড ডেন্স। অর্থাৎ ডেন্স মুভমেন্ট এবং থিয়েট্রিকেল অভিনয়ের সমন্বয়ে অভিনব পারফরম্যান্স। যার সাথে রয়েছে স্টাইল ও টেকনিকের সংযোজন। পাশ্চাত্যের মূকাভিনয়ে রয়েছে মুখের অবয়ব কেন্দ্রিক ও মুভমেন্টে অতিরঞ্জিত প্রভাব।
এখন প্রশ্ন উত্থাপিত হবে, বাঙাল মূকাভিনয়ের ক্ষেত্রে আমরা কি ভাবে পরিবেশন করব।
একই প্রদ্ধতির প্রয়োগ করলে নির্ণয় করতে হবে আমাদের নৃত্যের ও নাট্যশিল্পের মুভমেন্ট সমূহ। আমাদের নৃত্যের ঐতিহ্যের ভান্ডারে রয়েছে মুদ্রার প্রচলন যা পাশ্চাত্যের মূকাভিনয়ে মার্সেল মারসুও ব্যবহার করেছেন। রয়েছে বিভিন্ন ভঙ্গিমা, মুভমেন্ট, যার সাহায্যে বাঙলা মূকাভিনয়ের স্বক্রিয় বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে পারি। আমাদের ঐতিহ্যের নৃত্যের অনুশীলনে রয়েছে জিরো পজিশন। মূকাভিনয়ের এলাইনমেন্টের জন্য অত্যন্ত জরুরী। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতে আমাদের ঐতিহ্য নৃত্যের এই পজিশন ব্যবহার করে। এবার আসা যাক ঐতিহ্যের নাট্য সংস্কৃতির দিকে। যাত্রাপালার অতিরঞ্জিত অংগ সন্চালনের স্টাইল এবং ফর্মকে উপকরণ হিসাবে উপস্থিত করতে পারি বাঙলা মূকাভিনয়ে। আমাদের ঐতিহ্যের পারফরমিং আর্ট এর মধ্যে আরও রয়েছে লাঠি খেলা, হাডুডু যার বিশেষ মুভমেন্ট হবে উপকরণ।
মূকাভিনয়ের ফর্ম, স্টাইল এর সাথে রয়েছে ইলুশন টেকনিক যা ইউনিভার্সল। আমাদের ঐতিহ্যের নৃত্যের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় অনেক টেকনিকের ধারা। বাঙলা মূকাভিনয় এখন পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয় মাত্র।

তবে একটা কথা আমাদের স্বরণ রাখতে হবে যে, মূকাভিনয় নৃত্য শিল্পের বিভাগ অথবা নাট্য শিল্প অথবা নির্বাক অভিনয় নয়। মূকাভিনয় একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম। এই শিল্পের একটি বৈশিষ্ট্য আছে, নিজেস্ব ঢং আছে যা তার নান্দনিক প্রকাশে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। প্রকাশের ক্ষেত্রে সেই স্টাইল ভুলে আমরা যেন নিজেকে শুধু নির্বাক অভিনয় শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ না করে ফেলি সে দিকে সচেতন বা সচেষ্ট থাকতে হবে আমাদের।

বাঙলা মূকাভিনয় বা বাঙলার বা বাঙালীর মূকাভিনয়ের চিন্তাভাবনা বা চিন্তাধারা নতুন কিছু নয়। বাঙলার মূকাভিনয় শিল্পী সব সময়ই কোন না কোন ভাবেই এ নিয়ে পৃথক পৃথক ভাবনায় কাজ করেছেন বা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে। হয়ত এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করেনি কিন্ত দিক নিদর্শনা ছাপ পডেছে। শ্রী যোগেশ দত্ত এই উপমহাদেশে মূকাভিনয়ের চর্চ্চা শুরু করেন। তিনি বাঙালী সংস্কৃতির জীবনযাত্রা মূকাভিনয়ে প্রদর্শন করতে গিয়ে ইলুশনের ক্ষেত্রে টেকনিকের উদ্ভাবন করেছেন যা পাশ্চাত্যে মূকাভিনয় দেখা যায় না কারণ বাঙালীর লাইফ স্টাইল এবং পশ্চিমাদের জীবন যাত্রা ভিন্নতর। এমনি ভাবে নিরঞ্জন গোস্বামী ইন্ডিয়ান মাইম প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়ে কাজ করছেন।
পার্থ প্রতিম মজুমদারও যোগেশ দত্তের ছাত্র হিসাবে তার টেকনিকের ব্যবহার করেছেন। আমি বাঙালী জাতীয়তাবাদের উপর প্রবাসে দেশীয় বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক পারফরম্যান্স করেছি। জিল্লুর রহমান জনও দেশীয় পোশাক পরিচ্ছেদ ব্যবহার করেছে। এমনি ভাবে নতুন প্রজন্মের তরুন শিল্পীদের মধ্যে জাতীয় চেতনায় মূকাভিনয়ের ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। জাহিদ রিপন, রেজওয়ান রাজন, রঙন আহমেদ প্রমুখের মাঝে আমি দেখেছি মূকাভিনয়কে আমাদের নিজেস্ব সংস্কৃতির মূকাভিনয় গড়ে তোলা যায় কিনা । আমি মনে করি পাশ্চাত্যের মত আমরাও প্রাচ্যের মূকাভিনয় গড়ে তুলতে পারি, যা হবে বাঙলা মূকাভিনয় বা বাঙলার মূকাভিনয়।
অতএব আমরা আমাদের সংস্কৃতির সংযোজনের মাধ্যমে মূকাভিনয় শিল্পে একটি নিজস্বতা নির্মাণ করতে সক্ষম হব এতে কোন সন্দেহ নেই।

পরিশেষে বলব বাঙলার ঐতিহ্যবাহী সং শিল্প ও পাপেট শিল্প বাঙলা মূকাভিনয়ের বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ নিমানে আরও সমৃদ্ধ হবে।

লেখক :
বাংলাদেশের মুকাভিনয় জগতের অন্যতম লিজেন্ট, মাইম আইকন এবং ইন্টারন্যাশনাল মাইম এ্যম্বাসেডর অব বাংলাদেশ হিসাবে পরিচিত। মাইম গবেষক ও মাইম থেরাপি ডেভলপার।