কাজী মশহুরুল হুদা:
সম্প্রতি বাঙলা মূকাভিনয় গবেষণা কেন্দ্র আয়োজিত জাতীয় ভিত্তিক মূকাভিনয় প্রতিযোগিতায় প্রেরিত ফুটেজ দেখে এই লেখার প্রেরনা। বাঙলা মূকাভিনয়ের ধারনা ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে মূকাভিনেতাদের বোধগম্যতার জন্যই এই লেখা।
মূক ভাষায় বাঙলা মূকাভিনয় বিনির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এখন থেকেই গবেষণামূলক আলোচনার প্রয়োজন। কিভাবে আমরা এই প্রক্রিয়া শুরু করতে পারি, সে বিষয় নিয়ে গবেষণামূলক যাত্র শুরু হওয়া দরকার।
আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সূচনা সৃষ্টি করতে চাই যাতে আমরা সূচনার মাধ্যমে সমালোচনা ও দিক নির্দেশনা সৃষ্টির প্রয়াস পায়। আমি এখানে কিছু বর্ণনার মাধ্যমে সূত্রপাত করব যাতে গবেষক বা চর্চাকারী এই আলোকে পর্যালোচনার মাধ্যমে সমালোচনা করতে পারেন বা আরও গবেষণা করার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বাঙলা মূকাভিনয় বিনির্মাণের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।
মোটা দাগে আমি একটা লাইন সৃষ্টি করছি যেখান থেকে আমরা শুরু করতে পারি বা ধারনা এবং নিজস্ব সত্বার গবেষণামূলক চেতনা ও ধারণাপত্রের সূচনা সৃষ্টি হতে পারে।
ইতিপূর্বে আমি ঐতিহ্যের বাঙলা মূকাভিনয় বিনির্মাণের ক্ষেত্রে নানান তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করেছি বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখার মাধ্যমে। পর্যায়ক্রমে বাঙলা মূকাভিনয় প্রতিষ্ঠার জন্য লেখা চলবে।
আমি ইতিপূর্বে বাঙলা মূকাভিনয় বিনির্মাণে
তিনটি পর্বের কথা উল্লেখ করেছিলাম।
সূচনা পর্ব, গল্পের পর্ব এবং সমাপ্তি পর্ব।
১. সূচনা পর্ব:
সূচনা বা উপস্থাপনায় কিভাবে বাঙলা মূকাভিনয়ের স্বরূপ বা স্টাইল আনা যায় তারই ভাবনা হলো সূচনা পত্র। পাশ্চাত্যের মূকাভিনয়ে উদাহরণ স্বরূপ মার্সেল মার্সোর মূকাভিনয় প্রদর্শনীতে আমরা দেখতে পাই একজন নীরব সূত্রধর, যে কিনা মূকাভিনয় প্রদর্শনীর বিষয়টি তুলে ধরেন। সেখানে তার ভঙ্গিমায় থাকে ফরাসী সংস্কৃতির আদল। পোশাক পরিচ্ছদ এবং অঙ্গভঙ্গিমায় সেখানকার সংস্কৃতির ঐতিহ্য। যেমন- তরবারী যুদ্ধের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে বিষয়ের নাম তুলে ধরে।
সেই আলোকে আমরাও সূত্রধরের মাধ্যমে বিষয়বস্তু তুলে ধরতে পারি। যেমন- মঞ্চে শিল্পী এদেশের বিশেষ মুদ্রায় ফ্রীজ হয়ে থাকতে পারে এবং তার সামনে সূত্রধর বাঙলা সংস্কৃতির আদলে অর্থাৎ পোশাক ও অঙ্গ ভঙ্গিমায় ফ্রীজ হয়ে আছে। ধীরে ধীরে আলো জ্বলে উঠলে দেখা যাবে। এমনও হতে পারে লাঠিয়াল। লাঠি তুলে মারার ভঙ্গিমা এবং লাঠির সঙ্গে ঝুলছে বিষয় বস্তুর নামকরণ অথবা ঢোল বাদক। ঢোল বাজানোর ভঙ্গিমায় ডিজাইন করা ঢোলের উপর বিষয়বস্তু লেখা। সূচনা পর্বে বিষয়বস্তু দেখানোর পর নৃত্যের ভঙ্গিতে অথবা লাঠিয়াল তার আক্রমানাত্মক ভঙ্গিতে প্রস্থান করছে। এমনিভাবে বিভিন্ন ঐতিহ্যের আলোকে শুরুর পর্ব হতে পারে। আরও একটি উদাহরণ দিতে পারি। ঘোষণা পত্র খুলে প্রজাদের উদ্দেশ্যে যেমন পত্র পড়ে, তেমন ভঙ্গিতে বিষয়বস্তু তুলে ধরছে এবং শেষে ঘোড়ায় চড়ে চলে গেল ইত্যাদি।
নির্বাক সূত্রধরের প্রস্থানে দেশজ মিউজিকের সঙ্গে বিশেষ মুদ্রা থেকে বেরিয়ে আসছে মূকাভিনেতা। এই বেরিয়ে আসার বিমূর্ত মুভমেন্টের ভেতর থাকবে দেশজ নৃত্যের ভঙ্গিমা। এখানে উল্লেখ্য, মার্সেল মার্সো ফ্রীজ থেকে জীবন্ত হওয়ার সময় শারীরিক মুভমেন্টের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে গল্প শুরু করতেন এবং সেই মুভমেন্টের ভঙ্গিমা থাকত ব্যালের স্টাইলে। সূচনা পর্বে বিমূর্ততার ভেতর ফুঁটে উঠবে শৈল্পিকতা, দর্শক নন্দিত আবহ এবং মূকাভিনয় শিল্পকলার স্টাইল।
সেখানে আলোক প্রক্ষেপনে থাকবে নাটকীয়তা। সব কিছু মিলিয়ে এই সূচনা পর্ব হয়ে উঠবে আকর্ষণীয় এবং আর্টিস্টিক। বিষয়টির পরিবেশনা একক অথবা দলগত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দলগতের ক্ষেত্রে বিমূর্ত অঙ্গভঙ্গিমা থেকে বেরিয়ে এসে একে একে প্রস্থান করবে এবং শুরুতে যে সকল মূকাভিনেতা থাকবে, তাদের গল্পের পর্ব শুরু হবে।
২. গল্পের পর্ব:
মূকাভিনেতা মঞ্চে প্রতিটি মূহুর্তে একটা গতিতে চলবে যেখানে সময়ের কোন গ্যাপ থাকবে না। প্রতিটি মুভমেন্ট গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে। মুভমেন্টে থাকবে দেশীয় নৃত্যের ভঙ্গিমা এবং মুদ্রার ব্যবহার, যা মূলত: পৃথক নির্ণয় করবে পাশ্চাত্যের মূকাভিনয় ও বাঙলা মূকাভিনয়ের স্টাইল, টেকনিক এবং ফর্ম।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন নৃত্য শিল্পী সঙ্গীতের তালে নৃত্য পরিবেশন করে তার মধ্যে কোন গ্যাপ থাকেনা বা নেই। গ্যাপ হলেই পরিবেশনায় ছন্দ পতন ঘটবে। মূকাভিনয় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাবলিল গতিতে চলবে। মঞ্চে মূকাভিনয় চলা কালীন ইতস্তত অবস্থা, মূকাভিনয়ে বা গল্পে গ্যাপ সৃষ্টি করে। নৃত্য শিল্পী সঙ্গীতের তালে তালে নৃত্য করে, মূকাভিনেতা গল্পের তালে তালে মুভমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে ঘটনা তুলে ধরে, এই মুভমেন্টের তালে একটি অ্যাকশন থেকে অপর আরেকটি অ্যাকশনে যাবে ছন্দময়তার সঙ্গে। নৃত্য শিল্পীর মত কোনরকম থামবে না। গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তার নিজস্ব টেকনিক, ফর্ম ও স্টাইলে। যেখানে বোবা অভিনয় দিয়ে নয়, মূকাভিনয় দিয়ে শিল্পের শৈল্পিকতার প্রকাশ ঘটবে। কল্পনার জগতকে মোহ সৃষ্টির মাধ্যমে টেকনিক ও স্টাইলের ব্যবহারে মূর্ত করে তুলবে ঐতিহ্যের গল্প এবং ফর্মের ভেতর থাকবে নিজস্ব সংস্কৃতির ছন্দময়তা। নাট্যাভিনয়ের অভিনয় আর মূকাভিয়ের উপস্থাপনার ধরণ এক নয়। মূকাভিনয়ে অতিমাত্রিকতায় নাটকীয়তার প্রকাশ ঘটবে ও টেকনিক দিয়ে ঘটনার অবস্থান প্রকাশ পাবে। কল্পনার জগত মূকাভিনেতা যত স্পষ্ট ভাবে তৃতীয় নয়নে দৃশ্যমান করবে বা হবে, পারফরমেন্স তত উন্নততর হবে। মূর্ত এবং বিমূর্ততার সংমৃশ্রণে ঐতিহেৃর মূকাভিনয় অভিনবত্ব প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকবে মূকাভিনেতার।
প্রকৃত মূকাভিনেতার কাছে গল্পের পিছনে তার সময়, পজ, নমনীয়তার প্রকাশভঙ্গিমা থাকবে মার্জিত এবং সাবলীল। মূকাভিনয়ে মোহ সৃষ্টির টেকনিক সবচেয়ে জরুরী, তবে ঘনঘন একই মুভমেন্টের ব্যবহার গল্পের দূর্বলতা প্রকাশ পাবে। মূকাভিনয়ের বিষয়বস্তু টেনে লম্বা করার মধ্যে কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব হলো প্রকাশ ভঙ্গিমায়। ঐতিহ্যের মূকাভিনয় তৃর্ণমূল মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা, তার অভিব্যাক্তি বা প্রকাশে জাতি সত্বার প্রকাশ ঘটবে। এটাই বাঙলা মূকাভিনয়ের মূল সূত্র। প্রতিটি গল্পের ভেতর অর্থবহতা থাকবে। বিষয়বস্তুর মধ্যে সচেতনতার বার্তা ঘটনা প্রবাহে প্রকাশ ঘটবে।
৩. সমাপ্তি পর্ব:
মূকাভিনয় স্কেচ এর তিনটি পর্বের সূচনা পর্ব হলো, প্রস্তুতি বা সূচনা। তারই ধারাবাহিকতায় মূকাভিনয় টেকনিকে স্ট্রাকচার দাঁড় করা এবং সমাপ্তি পর্ব দিয়ে পরিসমাপ্তি টানা। কথায় আছে যার শেষ ভালো তো সবই ভালো। শুরুতে যদি উপস্থাপনা আকর্ষনীয় করে তোলা যায় তাহলে বিষয়টি দৃষ্টি নন্দিত হয় এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়। থিয়েট্রিক্যাল মূকাভিনয়ে ফ্রিজ হওয়া এবং ধীরে ধীরে আলো কমে যাওয়ার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটানো যেতে পারে। আর্টিস্টিক পরিবেশনায় মূকাভিনয়ের সমাপ্তি টানা যায়। স্লো মোশান অথবা হঠাৎ ফ্রীজ হওয়া অথবা শুরুতে যে পোজ থেকে সূচনার পর্ব শুরু হয়েছিল সেই পজিশনে ফিরে গিয়ে ফ্রীজ হওয়া যায় এবং ধীরে ধীরে লাইট ডিম হয়ে যাবে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় গল্পের প্রয়োজনে স্কেচ এর পর্ব শেষ হবে কিন্তু তার মধ্যে ক্রিয়েটিভ সৃষ্টির ধারণা দেওয়া হলো।
মূল কথা হলো, বাঙলা মূকাভিনয় প্রযোজনা বা উপস্থাপনায় ফোকাস থাকবে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার। পরিবেশ, মুভমেন্টে, ছন্দে, গল্পে, আয়োজনে, পোশাক-পরিচ্ছদে ইত্যাদির মধ্যে থাকবে বাঙালিপনা। সমকালীন সময়ে আধুনিকতার ভেতর দিয়ে ঐতিহ্যের মূকাভিনয়ে সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটানো সম্ভব। তার জন্য গতানুগতিক সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
(পরবর্তীতে বাঙলা মূকাভিনয়ের প্রক্রিয়া ও ধারণা নিয়ে ভিডিও আলোচনা বা ডেমোনেসট্রেশন পর্ব প্রকাশ করা হবে)।