– কাজী মশহুরুল হুদা

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মূকাভিনয় শিল্প সম্পূর্ণরূপে অজানা ছিল। আমরাই তার গোড়াপত্তন করি। দেশের মানুষের কাছে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এটি পরিচিতি লাভ করে। সেই থেকে ধীরগতিতে যাত্রাশুরু। বিশেষত: শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত সমাজে এর পরিচিতি বেশি পায়। তবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রম হলেও নাটক বা নৃত্যের মত মূকাভিনয়ের প্রসার ঘটেনি। এর কারণ কি?

দেশে যে নিয়মিত মূকাভিনয় চর্চা হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। হচ্ছে, তবে তা পর্যপ্ত নয়। জরীপ করে দেখেছি বিশাল জনগোষ্টি এই শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে এখনও অজ্ঞ বা তাদের কাছে অজানা। কিছু মানুষ জানেন কিন্তু ভাসাভাসা। দীর্ঘ ৪০/৫০ বছর পর পর্যবেক্ষণ করে দেখাগেল বাংলাদেশে মূকাভিনয় শিল্প মাধ্যমের তেমন কোন প্রচার বা প্রসার বা চর্চা হয়নি। কিছু উৎসাহিত অনুরাগীর মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। এর কিছু কারণ অনুসন্ধান করেছি।

বাংলাদেশে নৃত্য, সঙ্গীত, অভিনয় ইত্যাদি সংস্কৃতিতে একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সেই তুলনায় মূকাভিনয় শিল্প একেবারেই শিশু। এখনও হাটি হাটি পা পা করে চলেছে। এর কারণ অনেক।
১. আমাদের মত প্রথম দিকের শিল্পীদের অনুপস্থিতি (এখানে উল্লেখ্য যে- দু-একজনের উপর নির্ভর করে একটি শিল্প স্থায়ী লাভ করবে এটাও ভাবা ঠিক নয়। জীবনের তাগিদে সবাই এক সময় ব্যস্ত হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি শিল্প তখনই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে যখন তা নিয়ে অনেকের আগ্রহ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে)।
২. অধিক পরিসংখ্যক শিল্পী সৃষ্টি হয়নি।
৩. কোন উল্লেখযোগ্য ইন্সটিটিশন নেই।
৪. যোগ্য প্রশিক্ষকের অভাব।
৪. পর্যাপ্ত বই-পত্রের অভাব।
৫. সর্বপরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতার অভাব। ইত্যাদি
অনেকেই অভিযোগ করেন আমরা যারা শুরু করেছিলাম তারা বিদেশে চলে যাওয়ার কারণে এটি আগায়নি। এটি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আমরা নিজেদের তাগিদে, নিজেদের আগ্রহে, নিজেদের পছন্দে শিল্পটিকে আয়ত্ব করেছিলাম। বিদেশে এসেছিলাম শিল্পটিকে ভালোবাসার কারণেই। আরও ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য। আমরা চর্চা করেছি নিজেদের প্রচেষ্টায়। ঠিক এভাবেই সময়ের হাত ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মের আগ্রহ নিয়ে এ শিল্পের প্রতি ঝুঁকতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে। তবে আমাদের দায় যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়, আমরা যেখানেই থাকি দেশের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনটা খুব জরুরি। আমরা নতুনদের পথ দেখাতে পারি। শিল্পটিকে পরিচিত করতে তাদের পাশে থাকতে পারি। আর সেই তাগিদেই নিজের অর্থ ব্যয় করেই কিছু কাজ শুরু করেছি।

তবে ক্ষোভের কথা হচ্ছে- আমরা সংস্কৃতিবান মানুষ এই শিল্পকে নিয়ে ভাবিনা। না ভাবারও কারণ আছে। নিজেস্ব সংস্কৃতির সাথে মেলাতে না পারায় আগ্রহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি।

প্রশ্ন হল কি করলে এই শিল্প মাধ্যমকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে? উল্লেখিত বিষয় প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে আমি যে দুটি বিষয় অনুধাবণ করেছি, তার একটি হল মূকাভিনয় শিল্পকে নিজ সংস্কৃতির সাথে মেলাতে হবে। এই জন্য ইতিমধ্যে আমরা বাঙলা মূকাভিনয় গবেষণা কেন্দ্র চালু করেছি। যাতে মূকভিনয় শিল্প মাধ্যমকে বাঙলার সংস্কৃতির সাথে জড়িত করে নিজেস্ব জাতীসত্তার ব্রাণ্ড হিসেবে মূকাভিনয় রীতি বিনির্মাণের মাধ্যমে নৃত্য, যাত্রা, সঙ্গীতের মত বাঙলা মূক শিল্প গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে বাঙলা মূকাভিনয়ের আন্দোলন তৈরি হয়েছে। চর্চার মনমানসিকতা চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে বাঙলা মূক রেঁনেসার উদ্ভাবন হবে। এক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্টপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রধান কার্যক্রম হতে হবে নতুন প্রজন্মকে মূকাভিনয় সম্পর্কে আগ্রহ, উৎসাহ-উদ্দীপনা, সচেতনতা, জ্ঞান, চর্চার প্রতি যত্নবান এবং পরিকল্পনা নেওয়া। স্কুল পর্যায় থেকে যদি শিশু কিশোরদেরকে প্রশিক্ষণ বা চর্চার প্রতি আগ্রহ ও ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়, যেমন- ছোটবেলা থেকে গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয় চর্চার পাশাপাশি মূকাভিনয় শিল্পটিকেও চর্চায় আনা যায় তাহলে সারা বাংলাদেশব্যাপী এই শিল্পের প্রচার প্রসার ঘটতে বাধ্য হবে।

আমি পরীক্ষামূলক ঝিকরগাছা প্রি-ক্যাডেট স্কুলের ছাত্র/ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করে দেখেছি। তারা মূকাভিনয় সম্পর্কে কেউ কিছুই জানেনা বা দেখেওনি। কিন্তু তাদেরকে প্রদর্শন করে দেখলাম অত্যান্ত আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের নিয়ে তাৎক্ষনিক কর্মশালার মাধ্যমে কিছু কাজ করলাম, তারা অতিদ্রুত বিষয়টি সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করলো এবং তা অনুধাবন ও অনুকরণ করে ফেললো। অর্থাৎ তাদেরকে এবিষয়ে আলোকপাত করলে আগ্রহ সৃষ্টি করাতে কোন বেগ পেতে হবে না। সহজেই শিল্প মাধ্যমটিকে আয়ত্ব করতে পারবে।

তাই আমি পরীক্ষামূলক পাইলট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। ‘এসো মূকাভিনয় শিখি’ নামক (প্রাথমিক শিক্ষার) বই প্রকাশ করব। (শুধুমাত্র শিশু কিশোরদের জন্য) এবং প্রি ক্যাডেট স্কুলের ছাত্র/ছাত্রীদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। এমনি করে যদি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি চর্চার কারিকুলাম হিসেবে মূকাভিনয়কে সংযোগ করা যায় তাহলেই নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে আগামীতে দেশে বাঙলা মূকাভিনয়ের মাধ্যমে শিল্পটিকে জাতীয় ভিত্তিক সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।

ঠিক একইভাবে দেশে এখন অনেক সংগঠন, অনেক শিল্পী, অনেক কাজও হচ্ছে। তারা যদি মূকাভিনয় শিল্পকে আন্দোলনে রূপ দিতে পারে তবে এটি তার অবস্থান তৈরি করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

সেজন্য সত্যিকারের কিছু মূকাভিনয় শিল্পী প্রয়োজন। যাদের দেহ তৈরি হবে মূকাভিনয়ের জন্যই। যারা স্টেজে উঠলেই দর্শক বিমোহিত হয়ে যাবে। দেহের ছন্দ, তরঙ্গ, নান্দনিক অঙ্গভঙ্গি চোখের প্রশান্তি আনবে। যা দেখে নতুন প্রজন্ম শিল্পটির প্রতি আকৃষ্টি হবে। এটা খুবই জরুরী।