কাজী মশহুরুল হুদা
মূকাভিনয় যদি কথা না বলার অভিনয় হয়, তাহলে নির্বাক অভিনয় বলা যায়। এ ক্ষেত্রে মানুষ জন্ম থেকেই মূকাভিনয় করছে বা পৃথিবীর আদি অবস্থান থেকেই মূকাভিনয় চর্চা চলে আসছে বলতে পারি। চার হাজার বছর আগের সংস্কৃতি অনুসন্ধান করলে আকার ইঙ্গিতে মানুষের জীবনযাত্রায় রীতি নীতির মধ্যে কথা না বলে প্রকাশভঙ্গির ইতিহাস দেখতে পাই।
এ প্রসঙ্গ টানার অর্থ হল আজকের মূকাভিনয় শিল্প কিভাবে সমকালীন অবস্থানে গড়ে উঠেছে? এবং তার ধারাবাহিকতা কি? সে সম্পর্কে সংক্ষেপে বিতর্কের অবসান ঘটানোর চেষ্টা বা আলোকপাত করা।
নির্বাক অভিনয় বিভিন্ন দেশে, জাতিতে সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বহু প্রাচীনকাল থেকেই গড়ে উঠেছে। যেমন- কাবুকি, নো থিয়েটার, চাইনিজ অপেরা ইত্যাদি।
ভারত বর্ষে নৃত্যশিল্প সমৃদ্ধ। অনুশীলনে পশ্চিমা দেশের ব্যালে নৃত্যে তার প্রভাব আছে। ভারতের নাট্যশাস্ত্রে আঙ্গিক অভিনয়ের উল্লেখ আছে, যা নাট্যশাত্রের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে মূকাভিনয় শিল্পের উৎপত্তি বা প্রচলন ভারত বর্ষের, পাশ্চাত্যের নয়।
আমরা বর্তমানে যে মূকাভিনয় চর্চা করি তা একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম হিসাবে। এই শিল্প মাধ্যম তথা পারফরমিং আর্ট একটি ধারাবাহিকতায় নির্মিত হয়েছে। এখানে বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে স্মরণ করে শিল্প মাধ্যম সৃষ্টির দাবী করা সমীচীন হবে না। ভারতবর্ষের নাট্যশাস্ত্রের আঙ্গিক অংশ থেকে পূর্ণাঙ্গ মূকাভিনয় শিল্পের অবদান নেই। শাস্ত্রের ব্যবহারিকতা যদি পূর্ণাঙ্গ অবয়ব রুপান্তরিত বা নির্মাণ না করে তাকে স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম বলা যাবে না। আজ বিশ্বে মূকাভিনয়কে কেন্দ্র করে ঐতিহ্য বা লোকজ মূকাভিনয় নির্মিত হয়েছে। বিমূর্ত অবয়বে আধুনিক (কর্পোরেল) মূকাভিনয় সৃষ্টি হয়েছে। ফিজিক্যাল মূকাভিনয় থিয়েটার গড়ে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, আধুনিক মূকাভিনয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতি আধুনিক বা অত্যাধুনিক মূকাভিনয় আর্ট গড়ে উঠছে। ঐতিহ্য বা লোকজ মূকাভিনয় অর্থাৎ মূর্ত অবয়বে তিনটি শৈলী মূকাভিনয় স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন- ইটালিয়ান মূকাভিনয় স্কুল, ফরাসী মূকাভিনয় স্কুল এবং প্রাচ্য মূকাভিনয় স্কুল। এই স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই সব দেশ, জাতি ও তার সংস্কৃতির আলোকে। ইটালিয়ান, ফরাসী মূকাভিনয়ের ইতিহাস ইতোমধ্যে আমাদের জানা হয়েছে। প্রাচ্য মূকাভিনয় অক্রোবেটিক অর্থাৎ দৈহিক কসরতের মধ্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তা চায়নিজ সার্কাস দেখলে অনুমান করা যায়। যখন বিক্ষিপ্ত অংশ নানান সংযোগের মাধ্যমে তৈরি করে পূর্ণাঙ্গ ফর্ম, নিজেস্ব স্টাইল ( শৈলী ), নিজেস্ব টেকনিক নির্মিত হয় তখন আর্টে পরিণত হয়।
বর্তমান সময়ে মার্সেল মার্সোর ফর্ম, স্টাইল, অভিনয়ের অনুভূতি ও টেকনিকের সম্মিলন ঐতিহ্যের মূকাভিনয়ের নতুন মাত্রার সৃজনশীল সৃষ্টি।
সমকালীন মূকাভিনয় শিল্প তেমনি একটি পার্ফমিং আর্ট, যার দৃষ্টি নান্দনিক। আমরা এই সকল স্কুলেরই চর্চা করি এবং মূকাভিনয় একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম হিসাবে গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির আলোকে ও তাদের প্রচেষ্টায়। আমরা তাদের অনুকরণ বা অনুশীলন করছি। আমরা যেটা করতে পারি তা হল মূকাভিনয় শিল্পকে আমাদের সংস্কৃতির আলোকে নিজেস্ব ফর্ম নির্মান।
এখন আসা যাক বাঙলা মূকাভিনয় সম্পর্কে। আমি যেটাকে ব্রাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। কারণ ইটালি, ফরাসি, প্রাচ্যের মূকাভিনয় গড়ে উঠেছে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার ইতিহাস থেকে। বাঙালী জাতিরও জীবনযাত্রার ইতিহাস রয়েছে। বাঙলা মূকাভিনয় গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে আমাদের নিজস্ব বাঙলা মূকাভিনয় রীতি থেকেই বিনির্মাণ। যা হতে পারে ভিন্ন ধারা। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে যেমন- ইটালীয় মূকাভিনয়, ফরাসী মূকাভিনয় গড়ে উঠেছে- তেমনভাবে আমাদের সংস্কৃতির আলোকে আমরা আমাদের নিজেস্ব স্কুল নির্মাণ করতে পারি।
বাঙালী এবং বাংলাদেশী সংস্কৃতি নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনায়। আমরা এই উন্মাদনা পরিহার করেই গবেষণা করার পক্ষপাতি। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙলী জাতীয়তাবাদের চেতনার দৃষ্টিতে গবেষণা করার চেষ্টা করছি।
অঙ্গভঙ্গিমায় আমাদের নৃত্যের ছন্দময় শৈলীর ব্যবহারে অন্যান্য স্কুল থেকে পৃথক স্কুল নির্মাণ করতে পারি।
পূর্ব বাঙলায় সুলতান, মোগল আসার পূর্বে আদিবাসীদের বসবাস ছিল, তারা ছিল মনসার পূজারী। বাসকরত নৌকায় অথবা জঙ্গলে। তাদের পরনে ছিল লজ্জা নিবারণের বস্ত্র মাত্র। সেখান থেকে বিবর্তন ঘটেছে। ধর্মীয় চেতনায় নির্মিত হয়েছে সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা। গড়ে উঠেছে পূর্ব বাঙলার মানুষের জীবনযাত্রার সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতি আমাদের শেকড়। অতীত শেকড়কে অবলম্বন করে বর্তমান সময়ে প্রবেশ করছি।
আমাদের শিল্পের মূল্য অবশ্যই আমাদের সময়কে প্রতিফলতি করবে, তবে তা অবশ্যই সময়ের বাইরেও প্রতিফলিত হবে। মোদ্দা কথা, অতীত থেকে শিকড় গ্রহণ এবং সৃজনশীল মন দিয়ে বর্তমান এবং ভবিষ্যতে প্রবেশ করা বাঙলা মূকাভিনয়ের গবেষণা কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।